টেমি চা বাগান (Temi Tea Garden), ১৯৬২ সালে সিকিম সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চা বাগান যা দক্ষিণ সিকিমের টেমিতে অবস্থিত যা রাবাংলা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি সিকিমের একমাত্র চা বাগান এবং ভারত ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এখানে শীর্ষ মানের চা উৎপাদিত হয়, যার আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা আছে। বাগানটি পাহাড়ের ঢালের উপর স্থাপিত। এই বাগানে উৎপাদিত চাও আংশিকভাবে “টেমি চা” নামেও বাণিজ্যিক ভাবে পরিচিত। অর্গানিক চা চাষ হয় বটে তবে আদতে জায়গাটা স্বর্গের নন্দন কানন। হয়ত নন্দন কাননও এর কাছে তুচ্ছ। যতদূর চোখ যায় ঢেউ খেলানো চা গাছের সারি। উঁচু নিচু। পাহাড়টা যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখানে আকাশের নীল নেমেছে সবুজের বুকে। কি স্বচ্ছ নীল। তার মধ্যে স্ফটিকের মত মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন মনে। আপনি যদি দক্ষিণ সিকিম বেড়াতে যান আর টেমি টি গার্ডেন না যান তবে আপনার ঘোরা যেন সম্পূর্ণতা পায়না। পৃথিবীর সেরা ফ্লেভার্ড জায়গাগুলির মধ্যে টেমি একটি। একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা অন্যদিকে পাহাড়ী ঢালে সবুজে মোড়া বিস্তৃত চা বাগান, নানা রকম পাখির ডাক আর নিঃস্তব্ধ প্রকৃতি। শীতকালে এই শোভা আরও বেড়ে যায় যখন বাগানের মাঝে মাঝে চেরি ব্লসমরের ফুল গুলি ফুটে ওঠে। আর সঙ্গে যদি থাকেন কোন প্রিয়জন আপনার ছুটির আমেজ যেন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। জৈব চা উৎপাদনের জন্য সুইজারল্যান্ডের IMO দ্বারা নির্দেশিত নির্দেশিকা টেমির চা বাগানে গৃহীত হয়েছে। জৈব চা উৎপাদন প্রকল্প ২০০৫ সালের এপ্রিলে শুরু হয় এবং সমাপ্তির পথে এই প্রকল্প। ক্রমবর্ধমান জৈব সারে চা চাষ করে এগ্রো-কেমিক্যালগুলি এড়ানো যায় যা উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়। অনেক ইউরোপীয় দেশ ও জাপান জৈব সার পদ্ধতি ব্যবহার করে চা উৎপাদন এর জন্য অগ্রাধিকার দেখাচ্ছে। এই টি এস্টেট নির্মাণের পূর্বে জমিটিতে শেরপাদের গ্রাম ছিল। মিশনারি বিল্ডিংয়ের (যা সাউথ ও ওয়েস্ট ডিভিশনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের অফিস ও বাসস্থান ছিল) চারপাশে বন বিভাগের প্রায় ১০ একর নার্সারি ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময় এই সাইটটি ১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে স্কটিশ মিশনারি বিল্ডিং হিসাবে এক মাইলফলক ছিল, ১৯৫৪ সালে সিকিম সরকার কর্তৃক এই ভবনগুলি অধিগ্রহণ করা হয়। এখানে উৎপাদিত চা কলকাতার নিলাম কেন্দ্রের নিলামে অন্যতম সর্বোচ্চ দর অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর রপ্তানীর সম্ভাবনা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং টেমির তহবিলটি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা করছে। সিকিমের ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট সিকিমের চা উৎপাদন বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তাদেরকে সিকিমে আরো চা বাগান প্রতিষ্ঠা করার জন্য উন্মুক্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ” উদ্ভিজ শস্য যেমন চা, কমলালেবু, দারুচিনি উৎপাদনের ও প্রক্রিয়াকরণ” সিকিমের শিল্প উন্নয়নের জন্য অগ্রজ ক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালর পরপর দুই বছর ধরে টেমি টি গার্ডেনকে ভারতবর্ষের চা বোর্ড ‘অল ইন্ডিয়া কোয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। টেমি টি গার্ডেন বর্তমানে ইউরোপ বিশেষতঃ জার্মানিতে ক্রমবর্ধমান জৈব চায়ের চাহিদা মিটাতে জৈব চা চাষে মন দিচ্ছে। জি আই প্রশংসাপত্র এর জন্য তারা আবেদন করেছে যা তাদের গুনগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করবে। তারা আরও টাকা বিনিয়োগ করছে। তাদের চা বিশ্ববাজারে চড়াদামে বিক্রি হয়।
আশেপাশের দ্রষ্টব্য স্থান
টেমি টি গার্ডেনের আশেপাশে দর্শনীয় বলতে, রাভাংলা বা নামচির মতনই। সম্পদ্রুপ্সে মনাস্ট্রি, নামচি চারধাম, নামচি রোপওয়ে, রক গার্ডেন, রাভাংলা বুদ্ধ পার্ক ইত্যাদি সবই দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়। ছোট গাড়ী ভাড়া পড়ে ৩০০০/- মতো। তবে যে সমস্ত ট্রাভেলাররা টুরিস্ট স্পটের ভীড়, সাইটসিনের দৌড়াদৌড়ি পছন্দ করেন না, শুধুমাত্র প্রকৃতির নির্জনতাকে উপলব্ধি করতে চান তারাই এখানে এসে থাকতে চান। টেমি টি গার্ডেনে ঢোকার মুখে সিকিম গভর্নমেন্ট এর একটি ছোট্ট স্টল আছে ওখানে বসে বাইরের এমন সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই পারেন। ওরাই বানিয়ে বিক্রি করে। ঐ স্টল থেকে চাইলে আপনি টেমি টি গার্ডেনের চায়ের প্যাকেটও কিনে আনতে পারেন।
কিভাবে যাবেন
নামচি থেকে টেমি চা বাগানের দূরত্ব ১৮ কি মি, শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব ১২০ কি মি। কম বেশি ৪ ঘন্টার যাত্রায় পৌঁছে যাওয়া যায়। গাড়ি ভাড়া ৩৫০০-৪৫০০ টাকা (সিজন অনুযায়ী ওঠানামা করে)। শিলিগুড়ির SNT বাসস্ট্যান্ড থেকে শেয়ার গাড়িতে নামচি পৌঁছে সেখান থেকেও যেতে পারেন জন প্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। যাওয়ার পথে দেখে নিতে পারেন সাইবাবা মন্দির, আলে গুম্ফা, কিতাম বার্ড সাংচুয়ারি, চার ধাম বা সিদ্ধেশ্বর ধাম, রক গার্ডেন, বাইচুং ভুটিয়া স্টেডিয়াম, দ্বাদশ জ্যোতি লিঙ্গ, দেবাদি দেব মহাদেবের বৃহৎ মূর্তি।
কোথায় থাকবেন
বর্তমানে বহু পর্যটক যান এই টেমি টি গার্ডেনে। তবে বেশিরভাগই রাভাংলা বা নামচি থেকে সাইটসিন করতে। কিন্তু টেমি টি গার্ডেনের পাশেই হোমস্টতে বসে গরম চা এর সঙ্গে ভোরবেলায় সূর্যোদয় দেখাও কিন্তু আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতার এক পরম প্রাপ্তি হতে পারে। সঙ্গে থাকবে হোমস্টের সুস্বাদু খাবার আর উষ্ম আতিথিয়তা। ভোরবেলা বেড়িয়ে পড়ুন এই চা বাগানের রাস্তা ধরে মর্নিং ওয়াকে। আপনার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলবে পাহাড়ী সুগন্ধ আর নৈঃসর্গিক প্রকৃতির রহস্যময় সব ভালোলাগারা। টেমি চা বাগানে রয়েছে সাধ্যের মধ্যে হোম স্টের ব্যবস্থা। হোমস্টের খরচ ১০০০-১৫০০ রুপী জনপ্রতি প্রতিদিন সমস্ত মিলসহ।
WhatsApp us