জীবনের এক ঘেয়ামি মুহূর্ত গুলোকে আড়াল করতে ঘুরে আসতে পারেন মেঘ, পাহাড়-পর্বত এবং ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের রাজ্য ভারতের স্কটল্যান্ড খ্যাত মেঘালয়ের (Meghalaya) শিলং ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের এলাকা চেরাপুঞ্জি থেকে। অনেকেই মেঘালয় ঘুরতে যেতে চান কিন্তু প্ল্যান সাজাতে পারছেন না। কিভাবে যাবেন, কিভাবে ঘুরবেন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন, খরচ কেমন হবে এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথায় জ্যাম লেগে যায়। নিম্নে একটা ধারনা দেয়া হলো, আপনি চাইলে এই প্ল্যানটাও কাজে লাগাতে পারেন নয়ত নিজের মত করে এই প্ল্যান মডিফাই করে নিজের মত করে এই প্ল্যান মডিফাই করে নিজের প্ল্যান বানাতে পারেন।
মেঘালয় ট্যুর প্ল্যান ১ম দিনঃ
ঢাকা থেকে প্রথমে সিলেট যাবেন। সেটা বাসে/ট্রেনে/প্লেনে যেতে পারেন। বাসে/ট্রেনে গেলে যেখানে নামাবে সেখান থেকে সিএনজি নিতে হবে তামাবিল বর্ডার পর্যন্ত যেটা ভারতে ডাউকি নামে পরিচিত। এতে সিএনজি ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা। আর যদি প্লেনে যান তাহলে এয়ারপোর্ট থেকে সিএনজি ভাড়া নিবে ১০০০ টাকা।
২য় দিনঃ ডাউকি বর্ডার
সকাল বেলা ডাউকি বর্ডারে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলুন। শিলং এর উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য ডাউকি বর্ডার থেকে কোন গাড়ি ভাড়া করবেন না। কারন বর্ডারে ভাড়া অনেক বেশি চাইবে। ৪০০০-৫০০০ রুপি চাইবে সারাদিন। তাই ডাউকি বর্ডার থেকে ১০০ রুপি দিয়ে অথবা একটু পায়ে হেঁটে ডাউকি বাজারে চলে যান। সেখান থেকে ট্যাক্সি কিংবা টাটা সুমো ভাড়া করেন। ভাড়া পড়বে ৩০০০ রুপি। শিলং পর্যন্ত যাবে এবং পথে সব সাইট সিন করাবে। তবে সাইট সিন এর সময় বিভিন্ন যায়গায় গাড়ির পার্কিং চার্জ আপনার দিতে হবে। পার্কিং চার্জ জায়গা ভেদে ৩০-৫০ রুপি। তাছাড়া বিভিন্ন সাইট সিন এর জায়গায় এন্ট্রি ফি আছে ৩০-৫০ রুপি। যদি কম খরচে যদি শিলং যেতে চান তাহলে ডাউকি বাজারে বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে পড়ুন, শিলং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করুন। একটা জিনিস মনে রাখবেন, বাস কোথাও দাঁড়াবে না, তাই আপনি সাইট সিন মিস করবেন। শিলং যেতে অনেক সাইট সিন আছে। তাই বাসে না যাওয়াই উত্তম। টেক্সি ভাড়া করার সময় আগেই বলে নিবেন যে আপনি উমঙ্গট নদী, উমক্রিম ফলস, বরহিল ফলস, এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিংনং (Mawlynnong) এবং রাওয়াই ভিলেজ এর Living Root Bridge ঘুরে তারপর শিলং (Shillong) যাবেন। সকাল ১০ টায় শুরু করলে এক এক করে সব সাইট ঘুরে তারপর মাওলিননং ভিলেজ ঘোরা শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে শিলং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করুন। প্রায় ২ ঘন্টা যাত্রা শেষে শিলং পৌছে হোটেলে চেক-ইন করে নিন এবং হালকা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে শহরের মধ্যেই ঘুরে বেড়ান। হোটেল বুক করবেন পুলিশ বাজার, শিলং এ। Agoda থেকে হোটেল বুক করলে ভাড়া কম আসে। পুলিশ বাজারে হোটেল ১২০০ রুপি থেকে শুরু। বিকেলে বিখ্যাত পুলিশ বাজারে শপিং করে নিতে পারেন কিংবা মুভি দেখতে পারেন। যদিও সিনেমা হলটা আহামরি তেমন কিছু না। পুলিশ বাজারের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ট্যাক্সিভাড়ার তালিকা দেওয়া আছে। এখান থেকে কালকের জন্যে ট্যাক্সি বুক দিয়ে রাখতে পারেন। সারাদিন ঘুরার জন্য টেক্সি ভাড়া পড়বে ৩০০০ রুপি। রাতে হোটেলে খাওয়া শেষে ভালো একটা ঘুম দিন।
৩য় দিনঃ শিলং ঘোরাঘুরি ( বিস্তারিত এই লিঙ্কেঃ Shillong)
সকালের নাস্তা শেষ করে শিলং সাইটসিয়িং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিন। এই দিন শিলং পিক, এলিফেন্ট ফলস, বিশপ বিডন ফলস, ক্যাথিড্রাল চার্চলেডি হায়দারী পার্ক, গলফ কোর্স, ওয়ার্ডস লেক এবং বারাপানি লেক ঘুরে দেখুন। রাতে শিলং হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করে লম্বা একটা ঘুম দেন।
৪র্থ দিনঃ চেরাপুঞ্জি ঘোরাঘুরি ( বিস্তারিত এই লিঙ্কেঃ Cherrapunji)
সকালের নাস্তা শেষে চেরাপুঞ্জির (Cherrapunji) উদ্দেশ্যে রওনা করুন। ঝামেলা এড়াতে আগের দিনই শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির জন্য টেক্সি বুক করে রাখবেন। ভাড়া পড়বে ৩০০০ রুপি। তবে একটা জিনিস মনে রাখবেন, শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাওয়ার ভাড়া এটা না। টেক্সি আপনাকে সারাদিন সময় দিবে। চেরাপুঞ্জি পৌছায়ে হোটেলে চেক ইন করে তারপর এই দিন মুয়েসমাই গুহা, নুকায়কালী ফলস, মাউকডক ভ্যালি, উইশেদং ফলস, ইকো পার্ক, সেভেন সিস্টার ফলস, রামকৃষ্ণ মিশন এবং থাংখারাং পার্ক ঘুরে দেখুন। রাতে চেরাপুঞ্জিতে থাকবেন। হোটেল ভাড়া চেরাপুঞ্জিতে একটু বেশি, ২০০০ রুপির মত পড়বে এক রাত। হোটেলে খাবার শেষে বিশ্রাম ও রাত্রি যাপন।
৫ম দিনঃ শিলং-ঢাকা
সকালে নাস্তা শেষে শিলং থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা করুন। যদি একদিনে চেরাপুঞ্জির সব সাইট ভিজিট করতে না পারেন তাহলে সকালে বের হয়ে সেগুলো ঘুরে সরাসরি ডাউকি বর্ডারে চলে আসুন। উইশেদং ফলসটা অনেক সুন্দর, একটু দূরে। তাই একদিনে চেরাপুঞ্জির সব সাইট ভিজিট নাও হতে পারে। টেক্সি ভাড়া ৩০০০ রপি নিবে পার ডে হিসেবে, সেটা শুধু চেরাপুঞ্জি থেকে ডাউকি বর্ডারে আসেন না কেন। তাই রিলাক্স ভাবে টুর করুন। ডাউকি বর্ডারে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করে রাতে সিলেটের পানসী / পাচভাই রেস্টুরেন্টে খাওয়া শেষ করে বাসে/ট্রেনে ঢাকা ফিরে চলুন।
খাওয়া দাওয়া
সকালের নাস্তা হিসেবে চা, পুরি, সবজি, ডিম / পাউরুটি, মাখন, আলু পরটা, ঘানি, চা। দুপুর ও রাতের খাবারের মেন্যুতে ভাত, ডাল, সবজি, ভর্তা, মুরগি/মাছ, সালাদ রাখতে পারেন। ইলিশ মাছ পাওয়া যাবে কিন্তু আমাদের দেশের মাছ ওখানে যেয়ে বেশি দাম দিয়ে খাওয়ার কোন মানে নয় না তার উপর আবার অনেক দিনের ফ্রিজিং করা। শিলং এর রেস্টুরেন্টে পর্ক (শুকরের মাংস), চিকেন (মুরগির মাংস) এবং মাছ বেশী। জিঞ্জার আ্যন্ড স্ক্যাই গ্রিল, কেনমোর এবং শিপ আ্যন্ড ডাইন রেস্টুরেন্ট হিসেবে দারুণ। অন্যদিকে শেফ’স মাল্টি কিউজিন রেস্তোঁরা যুক্তিসঙ্গত মূল্যে দারুণ খাবার পরিবেশন করে। সিসেম তার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রান্না এবং ঐতিহ্যগত উপজাতীয় রান্নার খাবারের জন্য পরিচিত।
খরচ
৬-৮ জনের দল হলে জন প্রতি আনুমানিক ১২-১৫ হাজার টাকায় রিলাক্স ট্যুর দিয়ে আসতে পারবেন। যদি শুধু কাপল হন তাহলে ৪০,০০০ টাকা বাজেট রাখতে হবে।
মেঘালয় কিংবা আসাম ভ্রমণে সহায়তামূলক কিছু টিপস
– ফেরার পথে তামাবিল সীমান্তে প্রায় সময়ই সিলেট ফেরার গাড়ি/বাস/সিএনজি পাওয়া যায়না। তাই যাবার সময় কোন গাড়ি বা সিএনজি ড্রাইভারের নম্বর নিয়ে রাখলে ফেরার পথে বর্ডার পার হয়ে তাকে ফোন করলেই তামাবিল সীমান্তে সে চলে আসবে।
– সিলেট থেকে তামাবিল বর্ডার পর্যন্ত সিএনজি ভাড়া সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা (শুধু যাওয়া বা আসা)। সময়ভেদে বেশীকম হবে।
– যাবার সময় ডাউকি বাজারেই প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশী টাকার বদলে ভারতীয় রূপি কিনে নিতে পারেন। এখনকার রেট হলো, প্রতি ১০০ টাকায় ৭৫ ভারতীয় রূপি। মনে রাখতে হবে, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অবৈধ।
– ডাউকি বাজারে ডলার ভাঙ্গানো যায়না। ওরা শুধু বাংলা টাকা আর রুপি লেনদেন করে। তাই যারা শিলং যাবেন না, শুধু সোনাংপেডেং যাবেন তারা গেলে শুধুমাত্র বাংলা টাকা নিয়ে যাবেন। আরেকটা বিষয়, ডাউকি বর্ডারে রুপির বিপরীতে বাংলা টাকার রেট অনেক ওঠা নামা করে। এই বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশ কয়লার ট্রাক আসে। যেই সপ্তাহে কয়লা ঢুকে ওই সপ্তাহে টাকার রেট কম দেয়।
– ডলার ভাঙাতে হলে ডাউকি বর্ডার থেকে শিলং শহর পর্যন্ত যেতে হবে।
– ভারতে ভিতর ছবি তুলতে গেলে সাবধান থাকবেন। কোথায় ছবি তুলতে পারবেন সেটা ড্রাইভার বলে দিবে। ডিএসএলআর ক্যামেরা থাকলে ৫০০ রূপি দেয়া লাগতে পারে। শিলং এর সব জায়গায় কম বেশি এন্ট্রি ফি আছে। সেটা ৩০-৫০ রুপির মধ্যে।
– যারা ঢাকা থেকে ট্রাভেল ট্যাক্সের কাগজ নিয়ে যেতে ভুলে যাবেন, তারা তামাবিল যাবার পথেই জৈন্তাপুর বাজারের ভেতরে সোনালী ব্যাংক থেকে অবশ্যই ১০০০ টাকা দিয়ে ট্রাভেল ট্যাক্স -এর কাগজ নিয়ে নিজ নিজ পাসপোর্টসহ তামাবিল বর্ডারে যাবেন।
– বাংলাদেশ ভারতের অন্যান্য সীমান্তের মতোই তামাবিল-ডাউকি বর্ডার সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
– তামাবিল-ডাউকি বর্ডার ঝামেলামুক্ত সীমান্ত। কেননা ইমিগ্রেশন/কাস্টমস-এর কাজ দু’পারেই খুব দ্রুত হয়। আর অন্যান্য সীমান্তের মতো এখানে এপার কিংবা ওপারে আমার থেকে কোন ঘুষ চায়না বা নেয়না কেউ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভালোভাবে থাকা এবং খাওয়া বাবদ দৈনিক ২০০০ রূপী যথেষ্ট। আর ঘোরাঘুরির জন্যে রিজার্ভ ট্যাক্সি-এর থেকে শেয়ারে টাটা-সুমোতে ভ্রমণ করলে যথেষ্ট টাকা সেভ হবে। লাগেজ যথাসম্ভব কম রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।