ভুটানিজদের কে ভুটান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলে "Bhutan is peace" সত্যিই শান্তির দেশ ভুটান। সাইজে ছোট এই মানুষ গুলা থেকে আমাদের অনেক বড় বড় বিষয় শেখার আছে। রাজার দেশ ভুটান ভ্রমণ কিভাবে করবেন ?
অক্সিজেনের দেশ,বজ্র ড্রাগনের দেশ, পাহাড়ের আর মেঘের দেশ, জং আর মন্দিরের দেশ, শান্ত ও নিয়ম তান্ত্রিক দেশ, যাই বলি না কেনো, ভুটান যেনো এই পৃথিবীর মাঝে ছোট্ট, নৈসর্গিক গোছানো ভূ- স্বর্গ! ভুটান দেশটা মাত্র ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আর ২০ টি জেলা নিয়ে গঠিত। যেখানে কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই, একটা গাড়ির হর্ন নেই, কারো আগে যাবার তাড়া নেই, কারোর মধ্যে অন্যকে পিছিয়ে দেবার ইচ্ছা নেই। রাস্তাঘাট অনেক প্রশস্ত এবং সেটার পাশেই পার্কিং করা থাকলেও সেটা কখনই জ্যামের কারন হয়না। গাড়ি সারা রাত রাস্তায় পড়ে থাকলেও কোন ক্ষতি হয়না। রাস্তাঘাটে কেউ একটু চকলেটের প্যাকও ফেলেনা, উন্মুক্ত স্থানে সিগারেট খায়না, বিদেশী হিসেবে আপনাকে ঠকাবার ধান্দায় থাকবেনা। যেখানে আকাশ ছোঁয়া কোন বিল্ডিং নেই। তবে ভুটানিজদের ট্রাডিশনাল ড্রেসই সবাই পরে। একটা ব্যাপার খুব মজার,উপরের পার্টটা ট্রাডিশনাল হলেও নিচে আধুনিক জুতা, কেডস, শু টাইপ জুতাই সবাই পরে।
বরকত ট্রাভেলসের বাসে (৬৫০ টাকা) রাত ৮টায় রওনা দিয়ে ঠিক সকাল ৭ টায় পৌঁছাবেন বুড়িমারি বন্দরে। এরপর ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে সকাল ১০ টায় চেংরাবান্দা অতিক্রম করে টাকা থেকে রুপি করে নিবেন।
এরপর শুরু হলো আসল জয়গা’র উদ্দেশ্যে যাত্রা। TOYOTA Alto দামাদামি করে ১৩০০ রুপিতে (৪ জন) ভাড়া নিয়ে সকাল ১১ টায় রওনা হবেন। পথে খুব সুন্দর গ্রামের দৃশ্য দেখতে পাবেন যদিও তা বাংলাদেশের যেকোনো হাইওয়েতে দেখা যায়। কিন্তু একই সাথে চা বাগান,রেললাইন দেখতে ভালোই লাগে। যাই হোক দুপুর ২.৩০ টায় জয়গা পৌঁছে ভারতের ইমিগ্রেশন অফিস থেকে EXIT PERMIT নিয়ে ভুটান বর্ডার Phuentsholing এর দিকে এগিয়ে যাবেন যেটা জয়গার ট্যাক্সি স্টান্ড থেকে মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা পথ।
ভূটান বর্ডার দিয়ে পৌঁছে হাতের ডান দিকেই ভূটান ইমিগ্রেশন অফিস। খুবই ছোট্ট একটা অফিসে মাত্র ৩ জন বসে আছেন কাজ করতে। তাদের পাসপোর্টের ফটোকপি, হোটেল বুকিং এর ফটোকপি, এক কপি পাসপোর্টের কপি দিতেই ইলেকট্রনিক ভাবে এন্ট্রি পারমিট পাসপোর্টের মধ্যে লাগিয়ে দেয়। রাতটি ফোয়েন্টশোলিং থাকার স্বীদ্ধান্ত নেন, কারণ রাতে গেলে মেঘের সাথে কোলাকুলি হবে না। ১০০০ রুপি (ট্রিপল বেড- ৪ জন) দিয়ে Tashi Delek Hotel এ রুম নিতে পারেন। ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যায় ফোয়েন্টশোলিং শহরটা ঘুরে দেখতে পারেন।
সকালে বেরিয়ে পরবেন থিম্পু পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাড়ির খোঁজ করতে। একটু আশে পাশে খোঁজ করলেই দেখবেন অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে একটা Alto (৪ সীটের) ভাড়া করবেন ২,৪০০ রূপি দিয়ে। রাস্তায় চলতে চলতেই অসম্ভব সুন্দর কিছু দৃশ্য দেখে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়ের মাঝে বিস্বয়করভাবে বাড়ি ঘর বানানো। এই দৃশ্যের পাশাপাশি একটু পরেই ঠাণ্ডা বাতাসে শীত শীত করতে লাগবে।
যত উপরে উঠতে থাকবেন, তত একটু একটু করে কান বন্ধ হয়ে আসতে থাকবে ঠাণ্ডায়। যাদের হাইট ফোবিয়া আছে তাদের একটু সাবধান থাকা উচিৎ কারণ উপরে উঠতে উঠতে জানালা দিয়ে থাকাতেই দেখতে পাবেন খাঁড়া হয়ে নিচে নেমে যাওয়া পাহাড়। এভাবেই ভিউ দেখতে দেখতে রাস্তার ধারে একটা রেস্তোরাঁয় বসে পড়তে পারেন দুপুরের লাঞ্চ করতে। ঠিক পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা খাবারের জায়গা। সেখানে খাবারে চিকেন ফ্রাইড রাইস এবং চোওমিন আর কফি খেয়ে নিতে পারেন। একটা কথা বলে রাখা ভালো যে পুরো ভুটানে চিকেন খুব অল্প পাবেন, কিন্তু বিফ আর পোর্ক পাবেন খুব বেশি, আর খাবারে একটা বিদ্ঘুটে গন্ধ পাবেন, বাজে না, কিন্তু একটু অন্যরকম যেটা আপনার বিরক্তির কারণ হতে পারে। এছাড়া খাবার দাবার মোটামুটি সস্তা এবং তারা ১৫০ রুপির একটা ফ্রাইড রাইস প্লেটারে (চিকেন/ বিফ/ রাইস উইথ প্রায় ২ জনের খাওয়ার যোগ্য খাবার পাবেন। তাই শেয়ার করে নিতে পারেন দুই জন মিলে, তাহলে অভার অল বাজেট আরও কমে যাবে।
তারপর যাত্রা আবার শুরু হবে থিম্পুর উদ্দেশ্যে, মাঝপথে মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা হলো কিচুক্ষণ এবং বিকেলের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেই থিম্পু পৌঁছে যা্বেন। ৫-৭ টি হোটেল দেখতে পারেন। এমনিতে অনেক দামি মনে হলেও একটু দামাদামি করে ১৮০০ রূপিতে একটা বড় রুম পেয়ে যাবেন। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে প্রথমেই চলে যেতে পারেন থিম্পুর অন্যতম আকর্ষণ- Buddha Spot এ। এক কথায় অসাধারণ একটা জায়গা, মনে হচ্ছিলো বুদ্ধা যেনো চূড়ার উপর বসে পুরো থিম্পু শহরকে নজরে রাখছেন। এছাড়াও পুরো উঠোন জুড়ে ছোটো বড় মূর্তি এবং আশে পাশের নৈসর্গিক প্রকৃতি জায়গাটাকে অনন্য সুন্দর করে তুলেছিলো! মন্দিরের ভেতরে কোন ফি ছাড়াই ভুটানিজ দের স্থাপত্য শৈলীর নৈপুণ্য দেখার মত হবে। সেখান থেকে থিম্পু নদীর ব্রিজ, ফার্মারস মার্কেট, চ্যাংযামটগ যং সহ আরো কিছু নির্দেশনা দেখে হোটেলে ফিরে আসতে পারেন।
কিছু কথাঃ
যারা বেশি টাকা খরচের ভয়ে পরিকল্পনা করতে পারছেন না তাদের উপকারে আসবে এই পোস্ট। আপনাদের অবশ্যই ৪ জনের একটা টীম হতে হবে। খাওয়া-দাওয়ায় কোন কার্পণ্য করা ঠিক হবে না, যখন যা খেতে ইচ্ছে হয়েছে তাই খাবেন। এই ভ্রমনে একেক জনের ১০ হাজার টাকা বাজেট ছিল।
আগের দিন একটি ঠিক করে রাখবেন। ঠিক করে রাখা গাড়িতে (৩৮০০ রুপি,৪-জন) করে সকাল ৭ টায় রওনা হবেন পুনাখার উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর দোচালা পাসের সৌন্দর্য এবং এখান থেকে ঐ দূরে এভারেস্টের বরফমাখা সুইচ্চ সাদা পাহাড় আপনাকে বিমোহিত করবেই। তারপর রওনা হয়ে ১ ঘন্টার মধ্যে পুনাখা জং ও সাসপেনশান ব্রীজে পৌছে যাবেন। সাসপেনশান ব্রীজ পার হয়ে ঐপারে যাওয়ার মুহুর্ত এবং ব্রীজের নিচের স্বচ্ছ পানির প্রবাহ সাথে হাজারো মাছের বিচরণ আপনাকে আন্দোলিত করবে বারবার। এখানে প্রায় ১ ঘন্টা থাকার পর রওনা হয়ে দোচলা পাসে আবারো কিচুক্ষণ সময় কাটাতে পারেন। তারপর সরাসরি পারো চলে যাবেন। পথিমধ্যে একটি পানির লেক ও পারু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখে হয়ে গেল। রাতে পারুতে Karma Lekzang Lodging ঠিক করতে পারেন ১৮০০ রুপি (৪ জন- ট্রিপল বেড) দিয়ে। রাতে পারো শহরটি ঘুরে দেখতে পারেন। খুবই চিমচাম ও ছোট্ট শহর এটি। যারা বিমানে করে ভুটান আসতে চান তারা ঢাকা থেকে সরাসরি পারু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করবেন। এরপর ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষ করে প্রথম দিন পারুতে ঘুরতে পারেন। এরপর উল্টোভাবে দ্বিতীয় দিন যেই প্লান ছিল সেটা করতে পারেন।
আগের দিন ঠিক করে রাখা গাড়িতে (৩৩০০ রুপি-৪ জন) করে ভোর ৬.৩০ টায় রওনা দিবেন চেলালা পাসের উদ্দেশ্য। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, দেবদারু গাছের সারি, রাস্তার কিনারে বরফের সাদা আবরণ, কিছুদূর পরপর বৌদ্ধদের বাহারী পতাকা, ঘোড়ার বিচরণ আপনাকে অন্যরকম এক স্বর্গে নিয়ে যাবে। প্রায় ২.৩০ ঘন্টা গাড়িতে করে ৩৯৮৮ মিটার উঁচু চেলালা পাসে পৌছাবেন। গাড়ি থেকে নেমেই চারিদিকের সৌন্দর্য, লাল-সাদা ঘোড়ার বিচরণ ও এভারেস্টের সাদা পাহাড় অন্যরকম আবেশ তৈরি করবে। এখানে প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে রওনা দিবেন টাইগার নেস্টের উদ্দেশ্যে। ১১ টায় টাইগার নেস্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে পারেন। নিচ থেকে দেখে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে তার কয়েকগুণ কঠিন ট্রাকিং করা। যা হোক মনের জোর আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে খাড়া পাহাড়ের আঁকাবাঁকা মোড়ানো পথ বেয়ে উপরে উঠতে লাগবেন। যতই উঠবেন মনে হবে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাই মাস্ক পরে নিবেন। ৩ মিনিট হাটার পর ১ মিনিট বিশ্রাম নিতে হয়। এ যেন হিমালয় পর্বত আরোহনের স্বাদ ! পথে অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে, বেহুশ হয়ে রাস্তায় বসে পড়তে পারে। পথিমধ্যে ড্রাই কেক, চকোলেট ও পানি খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিবেন। প্রায় ৩ ঘন্টা ট্রেকিং করে যখন টাইগার নেস্টের কাছে যাবেন তখন মনে হবে কষ্ট সার্থক, অপ্রতিরোধ্য। এখানে বলে রাখছি, শারিরিক ভাবে ফিট না থাকলে পরাজয় মেনে নিয়ে নিচে নেমে যাওয়াই উত্তম। আসে পাশে তাকালে মনে হবে, শত বছর আগে খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে এই রকম দৃষ্টি নন্দন,কারুকার্যময় স্থাপনা কিভাবে বানানো সম্ভব! যাই হোক টাইগার নেস্টের আশেপাশে ঘুরে দেখবেন এবং পাশের শীতল পানির ঝর্না ও বরফ দেখে শুধুই বিমোহিত হবেন। মহান আল্লাহ এই পৃথবীকে কত্ত সুন্দর করে সাজিয়েছে। এখানে প্রায় ১ ঘন্টা সময় কাটিয়ে আবারো নিচে নামা শুরু করবেন। ৫ টার দিকে নিচে নেমে পারো জং ও নদী দেখে থিম্পুতে চলে আসবেন ওই গাড়িতে করে এবং ঐ রাতেই ফোয়েন্টশোলিং চলে যাবেন। রাতে ফোয়েন্টশোলিং আগের হোটেলেই থাকতে পারেন। পরের দিন সকালে ইমেগ্রেশনের কাজ শেষ করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করবেন।
যেসব উল্লেখযোগ্য দিক গুলো সব সময় মাথায় রাখবেন:
- নিজের পাসপোর্ট, টাকা, টিকিট সব সময় নিজের সাথে রাখবেন এবং খেয়াল রাখবেন। হোটেলে রেখে বের হবেন না। সাথে নিয়েই ঘুরবেন।
- বাসে যদি ভুটান ভ্রমন করার ইচ্ছে থাকে তাহলে দার্জিলিং এ ২ রাত থেকে আসতে পারেন আসার পথে।
- যেই জায়গায় ভ্রমণ করবেন সব সময় গুগল ম্যাপ দিয়ে জিপিএস ট্র্যাক করে ভ্রমণ করবেন।
- ভুটান বাই এয়ারে না যাওয়াই উত্তম কারন ভুটানের এয়ারপোর্ট পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর এয়ারপোর্ট।
- যেখানে সেখানে ময়লা অথবা থুথু ফেলবেন না। পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতা যেমন নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে, ঠিক তেমনি পরিবেশ ও সুন্দর থাকে, তাই আসুন যেখানেই যায় না কেন পরিবেশ পরিষ্কার রাখি।
- টুরে আসলে মিনিমাম ৫-৭ দিন সময় নিয়ে বের হওয়া উত্তম। একটি দেশ দেখতে বের হলে ভাল ভাবেই দেখা উচিত। ২/৩ দেশ ৭ দিনে ঘুরার চিন্তা করলে ভালভাবে কোনটাই দেখা হয় না আসলে।