অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই প্রাচীন জনপদ বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও সিলেটের রয়েছে প্রসিদ্ধ ইতিহাস। সিলেটে বসবাসকারি বিভিন্ন আদিবাসীদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, পাহাড়, ঝর্ণা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্রের সম্ভার এই সিলেট দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী।
সিলেট ঘুরতে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে বর্ষাকাল এবং শীতকাল। আপনার যেই সময় ভালো লাগে সেই সময় ভ্রমন করতে পারেন। প্রায়ই বৃষ্টি হয় এখানে। এই সময় আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থাকে। তাই ঘুরতে গেলে একটি অন্যরকম সুন্দর আবহাওয়া পাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে সিলেট ট্রেনে চেপে যেতে পারেন। যারা রিলাক্স ট্যুর চান তাদের অনেকেরই প্রথম পছন্দ থাকে ট্রেন। ট্রেনের শোভন চেয়ার এর ভাড়া পড়বে ৩২০ টাকা এর মতো। চাইলে প্রথম শ্রেণীর চেয়ারেও যেতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়বে রাত ৯.৩০-১০ টায় এবং সিলেটে গিয়ে পৌঁছায় সকাল ৬ টায়। এছাড়া কলাবাগান, যাত্রাবাড়ি, ফকিরাপুল থেকে বাসেও যেতে পারেন। নন এসি ৮০০ টাকা। ৬ ধন্টার জার্নি। জ্যাম না থাকলে আগেই পৌঁছান যায়।
যদি সিলেট শহরের ভিতর থাকতে চান তাহলে একটি ভাল মানের হোটেল এর ভাড়া হবে এসি রুমের ১৮০০ টাকা এবং নন এসি ১০০০ টাকা। যদি Booking.com থেকে বুকিং দেন তাহলে আরেকটু কমে পেয়ে যাবেন। মেইন শহরে থাকবেন। উপশহরে থাকার দরকার নেই। ট্রেন থেকে নেমে অথবা বাস থেকে নেমে সিএনজি / রিক্সা নিয়ে হোটেল চলে যাবেন। হোটেলে যাওয়ার আগে পাঁচ ভাই হোটেল এ নাস্তা করে নিতে পারেন। সিলেট স্টেশন টু জিন্দাবাজার পাঁচ ভাই হোটেল লেগুনা ২০ টাকা ভাড়া। আপনি যদি ব্যচেলর হন তাহলে লেগুনাতে উঠতে পারেন। কাপল হলে সিএনজি/ রিক্সাই ভালো। তাছাড়া স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে চলে যেতে পারেন পানসী রেস্টুরেন্ট, ভাড়া নিবে ৪০ টাকা। সেখানে নাস্তা করে ৮ থেকে ৮.৩০ এর মধ্যে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট এর সামনে থেকে একটা রিক্সা নিয়ে নিন হোটেলে যাওয়ার জন্য। হোটেল পৌঁছায়ে একটু রিল্যাক্স করে ১০ টার মধ্যে বের হয়ে পড়ুন প্রথম দিন সাদা পাথর দেখতে !
প্রথম দিনঃ সিলেট- ভোলাগঞ্জ (কোম্পানীগঞ্জ )
দ্বিতীয় দিনঃ সিলেট-খাদিম নগর জাতীয় উদ্যান-মোটরঘাট-রাতারগুল-গোয়াইনঘাট-হাদারপাড়-বিছনাকান্দি–লক্ষনছড়া–পানথুমাই-গোয়াইন ঘাট- সারিঘাট-জৈন্তাপুর।
তৃতীয় দিনঃ সিলেট-সারি ঘাট-লালাখাল-জৈন্তা-তামাবিল-জাফলং-সিলেট/জৈন্তাপুর
প্রথম দিনঃ সিলেট- ভোলাগঞ্জ (কোম্পানীগঞ্জ ) কিভাবে যাবেন ?
সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। ভোলাগঞ্জ যেতে হলে হোটেল থেকে সিলেট শহরের কদমতলী আসতে হবে। কদমতলী থেকে আম্বরখানা পয়েন্টে আসতে হবে। আম্বরখানা পয়েন্ট থেকেই ভোলাগঞ্জের বাস/সি এন জি পাবেন। কদমতলী থেকে নেমে রিক্সায় আম্বরখানা পয়েন্টে যেতে পারেন, ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। আম্বরখানা থেকে ভোলাগঞ্জ ট্রলার ঘাট পর্যন্ত সিএনজি জনপ্রতি ১৫০ টাকা করে শুধু যাওয়া যায়। বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য বাস উত্তম। বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য সবথেকে সহজ উপায় হলো আম্বরখানা বাস স্ট্যান্ড থেকে : সাদাপাথর ট্যুরিস্ট বাস-৭০ টাকা/ বিআরটিসি ডাবল ডেকার বাস – ৬০টাকা দিয়ে ট্রলার ঘাট পর্যন্ত যাওয়া। আর আপনি যদি সিএনজি নিজের জন্য বুক করে ফ্যামিলি নিয়ে যেতে চান তাহলে ভোলাগঞ্জ ট্রলার ঘাট পর্যন্ত যাওয়া আসা বাবদ ১০০০ টাকায় রিজার্ভ করার চেষ্টা করবেন। ভাড়া যাওয়া আসা মিলে ১২০০/১৫০০ টাকা চাইতে পারে। যদি হোটেলের সামনে থেকে সিএনজি ঠিক করেন তাহলে ১২০০ টাকায় যাওয়া আসা ঠিক করার চেষ্টা করবেন। ভোলাগঞ্জ ট্রলার ঘাটে পৌঁছানোর পর জিরো পয়েন্টে সাদাপাথর যেতে হলে নৌকা/ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ভাড়া ৮০০ টাকা যাওয়া আসা সহ। বেশি চাইলে দামদর করবেন। ২ ধন্টার জন্য ভাড়া করা হয়। তাই সাদা পাথর যেয়ে ওখানে কিছু সময় থেকে আবার ২ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। আপনি বাড়তি জামাকাপড় নিয়ে জতে পারেন গোসল করার জন্য। জমা কাপড় পরিবর্তন করার জন্য ভালো ব্যাবস্থা আছে। নারী পুরুষ উভয়েরই ১৫ টাকা জন প্রতি নিবে। টয়লেট, ওয়াসরুম এর ভালো ব্যাবস্থা আছে। আপনার ঘোরাফেরা শেষ করে একই ট্রলারে চলে আসেন ঘাটে।
বিস্তারিতঃ
ভোলাগঞ্জ (Bholaganj) সিলেটের আর একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। রোপওয়ে, পাথর কোয়ারী আর পাহাড়ী মনোলোভা দৃশ্য অবলোকনের জন্য এখানে প্রতিদিনই আগমন ঘটে পর্যটকদের। সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। ভারতের আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ে এক সময় লোকজন এ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতো। কালের পরিক্রমায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রজ্জুপথ। নাম ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। দেশের সর্ববৃহৎ ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীর অবস্থানও এ এলাকায়। রোপওয়ে, পাথর কোয়ারী আর পাহাড়ী মনোলোভা দৃশ্য অবলোকনের জন্য এখানে প্রতিদিনই আগমন ঘটে পর্যটকদের।
কখন যাবেন ?
মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকায় যাওয়ার মোক্ষম সময়।
ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে
ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সাথে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। এই পাথর দিয়ে পঞ্চাশ বছর চালানো যাবে- এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। বৃটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্লান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন। দু’প্রান্তে ডিজেল চালিত দুটি ইলেকটৃক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনী , স্কুল,মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্লান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সংশিষ্টরা জানান, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, পাথরের অপর্যাপ্ততা ও বিকল ইঞ্জিনের কারণে দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে এক্র্ক্যাভেশন মেশিন বন্ধ রয়েছে। মজার ব্যাপা হলো, এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে-পিয়াইন নদীর সাথে। রোপওয়ের আয়তন প্রায় একশ’ একর। আর এ কারণেই স্থানটি পর্যটকদের কাছে এত আকর্ষণীয়।
পাথর আহরণের দৃশ্য
ভোলাগঞ্জ কোয়ারীতে শুষ্ক মওসুমে প্রধানত গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা প্রথমে কোয়ারীর ওপরের বালি অপসারণ করে। পর্যায়ক্রমে গর্ত খুঁড়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। ৭/৮ ফুট নিচু গর্ত খোঁড়ার পর কোয়ারীতে পানি উঠে যায়। পানি উঠে গেলে শ্যালো মেশিন দিয়ে কোয়ারীর পানি অপসারণ করে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে। এর বাইরে ‘শিবের নৌকা’ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের উপায় হচ্ছে-একটি খালি নৌকায় শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন লাগানো হয়। ইঞ্জিনের পাখা পানির নীচে ঘুরতে থাকে। পাখা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে মাটি নরম হয়ে পাথর বেরোতে থাকে। সংশিষ্টরা ঝঁকির সাহায্যে পাথর নৌকায় তুলে। এ পদ্ধতিতে সহস্রাধিক শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে থাকে। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও খুব উপভোগ্য।
ট্রলার থেকে নেমে আবার বাসে/সিএনজিতে করে দুপুর এর পর পর বিকালের মধ্যেই আবার চলে আসেন আম্বরখানা মজুমদার পয়েন্ট। সেখান থেকে রিক্সা নীয়ে চলে আসেন আবার পানসী রেস্টুরেন্ট। যদি রিজার্ভ সিএনজি হয় তাহলে তাকে পানসী হোটেলে নামিয়ে দিতে বলবেন সকালে ঠিক করার সময়। দুপুর এর খাবার বা রাতের খাবার যাই হোক খেয়ে নিন এখান থেকে। খাবার খেয়ে রিক্সা নিয়ে চলে যান হোটেলে বিশ্রাম করার জন্য।
ভাল লাগলে শেয়ার করুন।