চিন্তাফু ট্রেক (Chintaphu Trek) ভার্জিন রুট না হলেও খুব কম মানুষই এই পথে পা মিলিয়েছেন। চিন্তাফুর ব্যাপারে তাই খুব মানুষই জানেন। স্থানীয় গাইডরা চিন্তাফুকে সান্দাকফু এর বোন বলে। সান্দাকফুর থেকে চিন্তাফুর উচ্চতা মাত্র ৩৩মিটার কম। চিন্তাফুর উচ্চতা ৩৬৩৩মিটার অর্থাৎ ১১৯২৯ ফিট। চিন্তাফুর বৈশিষ্ট্য হল চিন্তাফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাই শুধু নয়, অক্টোবরের ঝকঝকে আকাশে এভারেস্ট, মাকালু ও লোথসেও খুব ভালোরকম দেখা যায়। সান্দাকফু থেকেও এই ভিউ পাওয়া যায় না।
যাঁরা ছোট ও কম সময়ের জন্য ট্রেকিং এর পাশাপাশি বেড়ানোর খোঁজ করেন তাঁদের জন্যে চিন্তাফু হতে সেরা অপশন। খরচ কম, ঝঞ্ঝাট কম, শনি রবির সাথে ছুটি নিতে হবে মাত্র দিন তিনেক। ট্রেকিংটাও মাত্র ওঠা নামা নিয়ে (৪+৪=৮) ৮ কিমি। বয়স কোনও বাধা হবে না।
ভ্রমণের সেরা সময়
চিন্তাফু বা চিন্তাপুর ট্রেকে মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রচুর রডোডেন্ড্রন সহ অনেক রকমের ফুলের সমাহার এর দেখা মিলে। জঙ্গল, উপত্যকা, প্রাকৃতিক জলাশয়, ঝরণা, ভাগ্যে থাকলে তুষারপাত আর মেঘ না ঢেকে রাখলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও সপারিষদ এভারেস্টের দেখা পাবেন।
যাওয়ার উপায়
শিলিগুড়ি থেকে যে পথ মিরিক হয়ে দার্জিলিং গেছে সেই পথে নেপাল সীমান্তে পশুপতিনগরে নেমে কেনাকাটা করেন নি এমন পর্যটক মেলা ভার। সেই পশুপতিনগর থেকে নেপালের গাড়ি নিয়ে ঘন্টা চারেকের পথ পেরিয়ে যেতে হবে ইলম জেলার মাইমাজুয়া। পথে দেখবেন মাইপোখরি নামে এক বিশাল জলাশয় সম্পূর্ণ গাছগাছালিতে ঢাকা। নেপালিদের কাছে খুব পবিত্র এই জলাশয়। চারপাশে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগবে। তবে ফেরার দিন দেখাই ভালো। যাবার দিন সময় কুলোবে না। মাইমাজুয়াতে থাকবেন কমল দাজুর হোমস্টেতে। মাইমাজুয়াতেও খুব ভালো ঝর্ণা আছে। সেটাও পরে দেখবেন।
১ রাত কাটিয়ে পরের দিন সকাল সকাল ল্যান্ডরোভারে রওনা দিন ১২ কিমি দূরের গরুয়ালিভঞ্জ। পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। আর একটা ছোট পবিত্র জলাশয়ের পাশে কিছু সময় কাটিয়ে পৌঁছে যাবেন ছোট্ট ছবির মতো গ্রাম গরুয়ালিভঞ্জে। এখানে থাকার জায়গা খুব সাধারণ কিন্তু চারপাশ অসাধারন। একটা রাস্তা বাঁদিকে চলে গেছে চিন্তাফু আর ডানদিকে সান্দাকফু। চা ও জলখাবার খেয়ে গাইড পোর্টার নিয়ে হাঁটতে শুরু করুন চিন্তাফু এর উদ্দেশ্যে। যদি রাতে থাক্ঙ্গেতে চান তাহলে অবশ্যই সাথে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে নেবেন। এ পথেও অসাধারণ ফুলেল সৌন্দর্য ও আর একটা ছোট পোখরি পাবেন।
জনমানবহীন গা ছমছমে চিন্তাফুতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ও মেঘেদের উপস্থিতি না থাকলে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে নেমে আসতে পারেন গরুয়ালিভঞ্জে। আর যদি ভোরের আকাশে সূর্যোদয় ও তুষারাবৃত শৃঙ্গ দেখার বাসনা থাকে তো দ্বিতীয় রাত কাটান চিন্তাফুর ট্রেকারস হাটে।
দ্বিতীয় রাত চিন্তাফু বা গরুয়ালিভঞ্জ যেখানেই কাটান, তৃতীয় রাত কিন্তু আবার কাটাতে হবে মাইমাজুয়াতেই। অর্গানিক চা, ঘরে তৈরী ঘি, কিছু অজানা পাহাড়ী ডাল কিনে নিতে পারেন হোমস্টের কমল দাজুর কাছ থেকে। তারপর ফিরে আসুন একই পথে পশুপতিনগর ও শিলিগুড়ি। ফেরার পথে সৌরিনী ও গোপালধারা চা বাগানের পাশে ক্যামেরা হাতে কিছু সময় কাটাতে ভুলবেন না।
দ্বিতীয় রুট – মানেভঞ্জন থেকে লামেধুরা, টুমলিং, জৌবারি, মাবু, মায়মাজুয়া, গুরওয়ালে হয়ে চিন্তাফু পৌঁছানো যায়। গুরওয়ালে থেকে চিন্তাফু ৬ কিলোমিটার।
তৃতীয় রুট – মানেভঞ্জন থেকে ধোত্রে চলে যান। ধোত্রে থেকে টংলু হয়ে টুমলিং, তারপর সেখান থেকে সান্দাকফু। আর সেখান থেকে আল হয়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হবে বেশ দুর্গম ১২ কিমি পথ, সময় লাগলো প্রায় ৪ ঘন্টার মতো। এর পরে পৌছানো যাবে বহু প্রতিক্ষিত গোরওয়ালে গ্রামে। সেখান থেকে চিন্তাফু আবার ৬ কিমি ট্রেক।
বাংলাদেশ থেকে যেভাবে যেতে পারেন
বাংলাদেশ থেকে যারা যাবেন, তাদের ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে নেপাল বাই রোডে ঢুকতে চাইলে। প্রথমেই শিলিগুড়ি থেকে কাঁকড়ভিটার উদ্দেশ্যে রওনা করুন। এই কাঁকড়ভিটা হলো ভারত নেপাল সীমানাবর্তী এলাকা। কাঁকড়ভিটা পৌঁছে সেখান থেকে নেপালে ঢোকার সকল ফরমালিটিস শেষ করে শেয়ার গাড়িতে চলে যান বিরথা মোড় বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে আমরা ইলাম যাবার শেয়ার গাড়ি পাবেন। ইলম হচ্ছে নেপালের ইলাম জেলার সদর শহর। দীর্ঘ ৫ ঘন্টা যাত্রা করার পর ইলাম শহরে পৌঁছানো যাবে। এই দিন আপনাকে ইলমে রাত্রি যাপন করতে হবে। সকাল থেকে ট্রেকের জন্যে যাত্রা শুরু।
পরেরদিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে রওনা দিন Biplate এর উদ্দেশ্যে। ইলাম থেকে Biplate যেতে সময় লাগে ২০ মিনিট। বাইপ্লেট থেকে Maimajua যেতে হবে। মাইমাজুয়া যাওয়ার শেয়ারড গাড়ি পাওয়া যায় কিন্তু বাইপ্লেট থেকে সেগুলো ছাড়ে দুপুর ১টার পর। আর যদি বাইপ্লেট থেকে হেঁটে যেতে চান, সেক্ষেত্রে সময় লাগবে আনুমানিক ৭ থেকে ৮ ঘন্টা।
Biplate থেকে মায়মাজুয়া হেঁটে যেতে চাইলে প্রথমে পৌছাবেন জসবীরে নামক একটি গ্রামে। সেখানে ক্ষনিকের চা বিরতি দিয়ে আবার ছুটে চলুন। ঘন্টাখানেক চলার পর পৌঁছাবেন মাইপোখরিতে। নেপালি ভাষায় পোখরি মানে পুকুর। স্থানীয় লোকেরা এখানে পুজো দিতে আসে। ছোট্ট মন্দির সহযোগে একটি সুবিশাল কুন্ড আর তার চারপাশের স্নিগ্ধতা এককথায় অবর্ণনীয়।
মাইপোখরি দর্শনের পর আবার যাত্রা শুরু করুন। অনেকটা সময় পেড়িয়ে পৌছাবেন ফরেস্ট রেজিমেন্টের এক সুন্দর ঝুলন্ত ব্রীজের কাছে। সেটা পার করে আরও ৪০ মিনিট হাঁটার পর অবশেষে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবেন মাইমাজুয়া। মাইমাজুয়াতে কমল দাজু (কমল গুরুং) এর হোমস্টে যথেষ্ট বিখ্যাত। এখানে রাত্রি যাপন করে পরের দিন সকালে রওনা দিতে হবে চিন্তাফু এর উদ্দেশ্যে।
পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে সকাল সকাল রওনা দিন গারুওয়ালের উদ্দেশ্যে, যেখানে নাঞ্চ করে তারপর রওনা দিতে হবে চিন্তাফু এর পথে। প্রায় দুপুর ১২ টা নাগাদ গারুওয়ালে পৌঁছে যাবেন। ছোট একটি জনবসতি এই গারুওয়ালে। গুটিকতক বাড়ি ঘর ছড়ানো ছিটানো। এই গারুওয়ালে থেকে ডানদিকে চলে গেলে সান্দাকফু যাবার রাস্তা আর বামদিকে চলে গেলে চিন্তাফু যাবার রাস্তা। এখানেই শেষ জলের উৎস পাওয়া যায়। এরপর যখন আমরা চিন্তাফুর জন্য রওনা হবেন, সারা রাস্তা আর কোথাও পানীয় জল পাবেন না।
লাঞ্চ সেরে সমস্ত বোতলে জল ভরে নিয়ে দুপুর নাগাদ রওনা দিন চিন্তাফু এর উদ্দেশ্যে। ম্যাগনোলিয়া ও রডোড্রেনডন গাছের জঙ্গল অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে হবে। কিছুটা উচ্চতা অতিক্রম করার পর তালপোখরি নামে একটি পুকুরের দেখা মিলবে। সেটাকে অতিক্রম করে উপরের দিকে উঠতে থাকুন। বিকাল ৪টার কাছাকাছি সময়ে চিন্তাফু পৌছে যাবেন কারন গারুওয়াল থেকে চিন্তাফু এর দূরত্ব ৩ কিমি।
থাকবার জায়গা
চিন্তাফু টপে আছে দু কামরার একটা ভাঙাচোরা ট্রেকারস হাট ও একটা ছোট্ট চালা ঘর।
WhatsApp us